মানুষ ও প্রাণিজগতের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের ওপর শব্দের বিস্তৃত প্রভাব শব্দদূষণ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী শব্দের বহিরাগত দূষণ মূলত যন্ত্রপাতি, পরিবহন এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে ঘটে। দুর্বল নগর পরিকল্পনা শব্দ দূষণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, পাশাপাশি শিল্পকারখানার ভবনগুলো আবাসিক অঞ্চলে শব্দদূষণের কারণ হতে পারে।

আবাসিক অঞ্চলে শব্দের মূল উৎসগুলোর মধ্যে উচ্চ আওয়াজের সংগীত, পরিবহন-ট্র্যাফিক, রেল, বিমান, ইত্যাদি, নির্মাণ কাজ, বৈদ্যুতিক জেনারেটর, এবং লোকজনের কোলাহল অন্তর্ভুক্ত। মানুষের বা কোনো প্রাণীর শ্রুতিসীমা অতিক্রমকারী কোনো শব্দ সৃষ্টির কারণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যানজট, কলকারখানা থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী তীব্র শব্দের উৎপত্তি হয়। মানুষ সাধারণত ২০-২০,০০০ হার্জের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পায় না। তাই মানুষের জন্য শব্দদূষণ প্রকৃতপক্ষে এই সীমার মধ্যেই তীব্রতর শব্দ দ্বারাই হয়ে থাকে। শব্দ মূলত ডেসিবেল (ডিবি)-এ মাপা হয়। বহু উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যুৎ জেনারেটর শব্দদূষণ সংক্রান্ত পরিবেশগত অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

গবেষণায় দেখা গেছে, আবাসিক অঞ্চলে গড় শব্দের মান ৯৭ ডেসিবেল, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত গড় আওয়াজ স্তর মান ৫০ ডেসিবেলের অনেক ঊর্ধ্বে। গবেষণা থেকে জানা যায়, স্বল্প-আয়ের এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের এলাকাগুলোতে শব্দদূষণ সর্বাধিক। উচ্চ শব্দের মাত্রা মানুষের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার প্রাব এবং করোনারি আর্টারি ডিজিজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। প্রাণীদের মধ্যে শব্দদূষণ মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে, প্রজনন এবং নেভিগেশনে প্রভাব ফেলতে পারে এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণ অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে। মানুষের কান যেকোনো শব্দের ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদী।

তাই তীব্র শব্দ কানের পর্দাতে বেশ জোরে ধাক্কা দেয় যা কানের পর্দাকে নষ্টও করে দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। শিশু বয়সে শব্দের অধিক তারতম্যের জন্য বৃদ্ধ বয়সে তাদের কানের বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। দলগতভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে শব্দদূষণের কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং দেখা গেছে- যেসব অঞ্চলে দূষণের মাত্রা বেশি সেখানে নিম্নলিখিত অসুবিধা বা ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়েছে :
(ক) দূষণ প্রভাবিত এলাকার মানুষের মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে, (খ) আচরণে অস্বাভাবিকতা ও মানসিক উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, (গ) মানুষকে ক্লান্ত, মানসিক অবসাদগ্রস্ত ও কাজে অমনোযোগী করে তুলছে, (ঘ) বয়স্ক মানুষের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং (ঙ) এমনকি বধির হওয়ার মতো খবর পাওয়া যাচ্ছে।
শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য এবং আচার-আচরণ- উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।

অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত শব্দের কারণে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিক কার্যকলাপ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাতসহ অন্যান্য ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি হতে পারে। বিমানের প্রচণ্ড আওয়াজের ফলে বিমানবন্দর এলাকার আশপাশে ব্যাপক শব্দ দূষণগত পরিবেশের সৃষ্টি করে।

রাতে এবং ভোরে যদি বিমান পরিচালনা করা হয় তখন ব্যক্তির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। শুধুমাত্র অবতরণ কিংবা উড্ডয়নের জন্যই বিমানের আওয়াজ সৃষ্টি হয় না, পাশাপাশি বিমান মেরামত, পর্যবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণের জন্যও এরূপ হয়ে থাকে। এর ফলে ব্যক্তি বিশেষত শিশুর শব্দদূষণগত কারণে শারীরিক এবং মানসিক বিকাশেও ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। বয়স্কদের শব্দের কারণে কার্ডিয়াকজনিত সমস্যা হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং শব্দদূষণ শিশুদের ওপর যে প্রভাব ফেলে তা স্থায়ী হতে পারে।

কোলাহল শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং শিশুর পড়াশোনা এবং আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শব্দদূষণ স্বাস্থ্য এবং আচরণ উভয়কেই প্রভাবিত করে। অযাচিত শব্দ শারীরবৃত্তীয় স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। শব্দ যখন ঘুম বা কথোপকথনের মতো স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে হস্তক্ষেপ করে বা কারও জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে বা হ্রাস করে তখন অযাচিত হয়ে ওঠে।

শব্দেরদূষণ প্রতিবন্ধী, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) বা শব্দের প্রতি অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা হতে পারে। এএসডি আক্রান্ত লোকেরা জোরে শব্দের সাথে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে অস্বস্তিকর শারীরিক সংবেদন পায়। যার ফলশ্রুতিতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয় এবং তাদের জীবনযাত্রাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। হঠাৎ উচ্চ আওয়াজ যেমন গাড়ির অ্যালার্ম এএসডি আক্রান্ত লোককে প্রভাবিত করতে পারে।

কোলাহল প্রাণীর ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে, শিকারি বা শিকার শনাক্তকরণ এবং এড়ানোর ক্ষেত্রে ভারসাম্য পরিবর্তন করে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এই প্রভাবগুলো পরোক্ষ প্রভাবের মাধ্যমে কোনো সমপ্রদায়ের মধ্যে আরও মিথস্ক্রিয়াকে পরিবর্তন করতে পারে। মানুষের ক্রিয়াকলাপের কারণে সমুদ্রের মধ্যে শব্দদূষণ হয়। প্রোপেলার এবং ডিজেল ইঞ্জিনগুলোর কারণে কার্গো জাহাজগুলো উচ্চ স্তরের শব্দ উৎপন্ন করে।

এই শব্দদূষণ বাতাসের কারণে সৃষ্ট নিম্ন-ফ্রিকোয়েন্সি পরিবেষ্টনের শব্দ স্তরকে উল্লেখযোগ্যভাবে উত্থাপন করে। যোগাযোগের জন্য শব্দের ওপর নির্ভরশীল সামুদ্রিক প্রাণীরা বিভিন্নভাবে এই আওয়াজ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। উচ্চ পরিবেষ্টিত শব্দস্তর প্রাণীদের আরও উচ্চস্বরে শব্দ সৃষ্টি করতে বাধ্য করে, যাকে লোম্বার্ড প্রভাব বলা হয়। গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, লো-ফ্রিকোয়েন্সি সোনারের কারণে হ্যাম্পব্যাক তিমির শব্দের দৈর্ঘ্য দীর্ঘ হয়। তারা দেখেন শব্দদূষণের ফলে সামরিক সোনারের উচ্চ আওয়াজের সংস্পর্শে আসার পরে কয়েকটি প্রজাতির তিমির মৃত্যু হয়েছে।

এমনকি সামুদ্রিক ইনভারটেবরেটস, যেমন কাঁকড়ার জাহাজের আওয়াজ দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে দেখা গেছে। বড় কাঁকড়াগুলো ছোট কাঁকড়ার চেয়ে শব্দ দ্বারা আরও বেশি নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত বলে চিহ্নিত হয়েছে। অ্যানথ্রোপোজেনিক শব্দের সংস্পর্শে আসার ফলে হাইপারসেনসিটিভিটি সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের শারীরবৃত্তির একটি বড় অংশ পরিবেশগত কম্পনগুলো শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে অভিযোজিত। ঘাসফড়িংয়ের ক্ষেত্রে সঙ্গী আকর্ষণ করার জন্য শব্দ উৎপাদন করার সময় অ্যানথ্রোপোজেনিক শব্দ অ্যাকোয়াটিক যোগাযোগকে প্রভাবিত করে।

শব্দ নিয়ন্ত্রণের ধারণাটি প্রায়ই পরিবেশ বা কর্মক্ষেত্রে শব্দ হ্রাস করতে ব্যবহূত হয়। শব্দ নিয়ন্ত্রণ শব্দ প্রসারণ হ্রাস করতে এবং ব্যক্তিদেরকে ওভার এক্সপোজার থেকে রক্ষা করতে ব্যবহূত হতে পারে। যখন শব্দ নিয়ন্ত্রণগুলো সম্ভবপর বা পর্যাপ্ত না হয়, তখন মানুষ শব্দদূষণের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিতে পারে। যদি মানুষ উচ্চ শব্দের আশপাশে থাকে তবে তারা শ্রবণ সুরক্ষা যেমন কানের প্লাগ বা কানের মাফল দিয়ে তাদের কানের সুরক্ষা দিতে পারে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে পেশাগত শব্দদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রয়াসে বিভিন্ন প্রোগ্রাম এবং উদ্যোগের উদ্ভব হয়েছে। এই প্রোগ্রামগুলো শব্দ সরঞ্জাম ব্যবহার এবং ক্রয়ের প্রচার করে এবং ডিজাইন করতে উৎসাহ দেয়।

নগর পরিকল্পনা এবং রাস্তার উন্নততর নকশা দ্বারা রোডওয়ে এবং অন্যান্য শহুরে শব্দদূষণ সংক্রান্ত কারণগুলোর হ্রাস করা যায়। যানবাহনের গতি সীমাবদ্ধতা, সড়কপথের পৃষ্ঠের জমিনের পরিবর্তন, ভারী যানবাহনের সীমাবদ্ধতা, ব্রেকিং হ্রাস করতে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং টায়ার ডিজাইন করে রোডওয়ে শব্দ হ্রাস করা যেতে পারে। এই কৌশলগুলো প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাস্তাঘাটের শব্দের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কম্পিউটার মডেল যা স্থানীয় টোপোগ্রাফি, আবহাওয়া, ট্র্যাফিক অপারেশন এবং হাইপোথেটিকাল প্রশমন করতে সক্ষম। শব্দবিহীন জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে বিমানের আওয়াজ হ্র্রাস করা যায়। এ ছাড়া ফ্লাইটের পথ ও রানওয়ের সময় পরিবর্তনের মাধ্যমে বিমানবন্দরগুলোর নিকটবর্তী বাসিন্দাদের শব্দদূষণের হাত থেকে রক্ষা যেতে পারে।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট
সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।